কয়েক বছর ধরেই দেশে বৈদেশিক সহায়তা ও অনুদানপ্রবাহে নিম্নমুখী ধারা বিদ্যমান। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর থেকেই এ প্রবণতার সূত্রপাত। সরকারও চেষ্টা করছে বৈদেশিক সহায়তা ও অনুদাননির্ভরতা কমিয়ে স্বাবলম্বী হতে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখছে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দাতা সংস্থাগুলোর পরিকল্পনার পরিবর্তন। যুদ্ধ ও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল বেড়ে যাওয়ায় দাতা সংস্থাগুলো এখন সেদিকে ঝুঁকছে। আবার উন্নয়নশীল দেশের দিকে অগ্রগতির কারণেও দাতা সংস্থাগুলো এখানে অর্থায়ন কমাচ্ছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরে দাতাদের অনুদান প্রতিশ্রুতি ৬৩ শতাংশ কমেছে। সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় বাড়িয়ে এ অবস্থা মোকাবেলায় সক্ষম হলেও সহায়তা কমায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে এনজিও খাতে। প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক অনুদান আসা এ খাত এলডিসি থেকে উত্তরণের পর পরই বড় ধাক্কা খাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও খাত–সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারলে অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও এনজিও খাত নিজস্ব সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে।
স্বাধীনতা–পরবর্তী কয়েক দশকে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অনুদানভিত্তিক যে ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওই সব কার্যক্রমেও পরিবর্তন আসা উচিত। আর এই নজির বিশ্বব্যাপীই রয়েছে যে কোনো দেশ নিম্নমধ্যম আয়ে উন্নীত হলে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো সেখানে অনুদানের বদলে সুশাসন ও সেবা খাত বিকাশে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর উচিত পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য এখনই প্রস্তুত হওয়া। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় এনজিওগুলোকে সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ স্বল্পোন্নত থেকে ভিন্ন। একসময় পরিমাণগত সম্প্রসারণের দিকে দৃষ্টি দিলেও এখন গুণগত মানে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশের এনজিও খাতের ভূমিকা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। সেটি ছিল উন্নয়নের প্রথম ধাপ। এখন দেশের অর্থনীতি টেকঅফ পর্যায়ে রয়েছে। সামনে এসডিজি অর্জনের চ্যালেঞ্জ। সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এনজিও খাতকেও এক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে আয়ের নতুন পথও অনুসন্ধান করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদনির্ভর সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে জোর দেয়া দরকার, সামাজিক মূলধন সৃষ্টির মাধ্যমে যার সূচনা হতে পারে।
বড় এনজিওগুলো টিকে আছে গবেষণা সেল থাকায়, নতুন নতুন প্রকল্প প্রস্তাব করতে পারছে। কিন্তু ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণায় ততটা এগিয়ে না থাকায় নতুন কিছু আনতে পারছে না। এ খাত ঘিরে কোনো প্রশিক্ষণ বা সরকারি পর্যায়ে গবেষণাও নেই। সরকারি বরাদ্দও পর্যাপ্ত নয়। এক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির একটি অংশ এনজিওগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে এতে অর্থের অধিক সদ্ব্যবহার নিশ্চিত ও অপচয় হ্রাস পাবে। উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলোয় এনজিও আছে। আমাদেরও প্রয়োজন হবে। এজন্য চাই নতুনত্ব ও সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তা। মালয়েশিয়া, ভারতের মতো অনেক দেশ নিজেরা তহবিল এনে তৃতীয় দেশে অর্থ ব্যয় করে। আমরাও সেটা করতে পারি। এজন্য প্রয়োজন সরকারের সহায়তা।
এনজিওগুলোর অর্থায়ন কাঠামো বহুমুখীকরণ এবং অগ্রাধিকার তালিকায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। প্রকল্প প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়নে আরো দক্ষতা–সক্ষমতার প্রকাশ থাকতে হবে। দাতা সংস্থাগুলো দারিদ্র্যনির্ভর প্রকল্প থেকে বেরিয়ে দক্ষতানির্ভর প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই এনজিওগুলোকেও এমনভাবে প্রস্তুত হতে হবে। পাশাপাশি অনুদাননির্ভরতা কমিয়ে আনতে সামাজিক এন্টারপ্রাইজ মডেল উন্নয়ন করতে পারে। মানুষ এখন সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন সেবা ও পণ্য চায়। দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসা জনসাধারণের নতুন নতুন চাহিদাও সৃষ্টি হচ্ছে। একে বিবেচনায় রেখে উদ্ভাবনী পথ ও প্রক্রিয়া বের করতে হবে। কাজের মধ্যেও নতুনত্ব আনা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশের চাহিদা অনুযায়ী সেবার বিস্তৃতি ঘটানো জরুরি। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর এ দেশে এনজিওগুলোর কাজের ক্ষেত্রও সম্প্রসারিত হবে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভিন্ন আঙ্গিক থেকে ভিন্ন রকম দায়িত্ব পালন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও প্রায় দেড় লাখ সক্রিয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি সে কথাই বলে।
উন্নয়ন হলে কিছু সমস্যা চলমান থাকে এবং কিছু সমস্যার উদ্ভব হয় নতুনভাবে। অর্থনৈতিক–সামাজিক–সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে সমস্যা থাকবে এবং করণীয় থাকবে, পরিবর্তিত হবে শুধু সেগুলোর ধরন ও প্রেক্ষিত। উন্নয়নশীল দেশের উপযোগী করে এনজিও খাতকে গড়ে তুলতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে। এনজিও ব্যুরো কেবল রেগুলেটরির দায়িত্ব পালন না করে প্রশিক্ষণ ও প্রকল্পে নতুনত্ব আনতে পারলে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সহজ হবে। দাতারা কোন কোন খাতে বরাদ্দে আগ্রহী, সেগুলো বিশ্লেষণ করে প্রকল্পে নতুনত্ব আনতে পারলে অর্থায়ন আরো বাড়বে। এরই মধ্যে পোশাক খাতের শ্রমিকদের মানোন্নয়ন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অনেক সংস্থা অনুদান দিচ্ছে। আগামীতে স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও অটোমেশনের ওপর কাজ করার বড় সুযোগ আছে। কিন্তু সেজন্য এনজিওগুলোকে এখনই ভাবতে হবে, বাড়াতে হবে গবেষণা। আগামী ২০ বছরের একটি পরিকল্পনা এখনই হাতে নিতে হবে।
