রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ লিমিটেড (আইসিবি) ২০১৭ সালে বন্ডের মাধ্যমে রয়েল টিউলিপ নামে পরিচিত সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডে ৩২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। এ অর্থ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি হোটেলটির নির্মাণকাজে ব্যয় করা হয়। আইসিবির কাছ থেকে অর্থ নেয়ার দুই বছর পর প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকেও তহবিল সংগ্রহ করে হোটেলটি। এভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ নিয়ে ব্যবসা করলেও আইসিবিকে কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করছে না প্রতিষ্ঠানটি। রয়েল টিউলিপের বন্ড কিনে আরো বিপাকে পড়েছে তারল্য সংকটে থাকা আইসিবি।
কক্সবাজারের ইনানী বিচে পাঁচ তারকা হোটেল রয়েল টিউলিপ ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। হোটেলটির চেয়ারম্যান লুসি আখতারি মহল। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তার স্বামী মো. আমিনুল হক। তিনি সান শাইন অ্যাপারেলস ঢাকা এবং তিন তারকা হোটেল সি ক্রাউনেরও চেয়ারম্যান। পাশাপাশি শামিম এন্টারপ্রাইজ (প্রা.) লিমিটেড, শামিম এন্টারপ্রাইজ প্রোপার্টিজ লিমিটেড, এলিট অটো ব্রিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও। এছাড়া ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) অনারারি ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের পর্ষদে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন মো. আমিনুল হকের ছোট ভাই ইকরামুল হক। বর্তমানে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্বে থাকা ইকরামুল হক হোটেল সি ক্রাউন, শামিম এন্টারপ্রাইজ (প্রা.) লিমিটেড ও শামিম এন্টারপ্রাইজ প্রোপার্টিজ লিমিটেডেরও পরিচালক। হোটেল রয়েল টিউলিপের আরেক পরিচালক হলেন মো. আমিনুল হকের পুত্রবধূ সারজানা ইসলাম।
১৫ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা ১০ তলাবিশিষ্ট হোটেল রয়েল টিউলিপ ভবনের মোট আয়তন সাড়ে ৪ লাখ বর্গফুট। ব্যাংকের কাছ থেকে উচ্চসুদে ব্রিজ ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে হোটেলটি স্থাপন করা হয়। নেদারল্যান্ডসের স্পেশাল পারপাস ভেহিকল (এসপিভি) জিটি ইনভেস্টমেন্টের সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজি চুক্তির ভিত্তিতে রয়েল টিউলিপ হোটেলের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড। কিন্তু হোটেল ব্যবসা থেকে আসা নগদ প্রবাহ দিয়ে ব্যাংকের উচ্চসুদের ঋণ পরিশোধ করা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়লে এগিয়ে আসে আইসিবি।
রয়েল টিউলিপের বন্ড অনুমোদনের সময় আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মো. ইফতিখার–উজ–জামান। তিনি বলেন, প্রকল্পটি যথেষ্ট সম্ভাবনাময় ছিল। এর যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে সেটি আইসিবির ৩২৫ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য যথেষ্ট। সবকিছু বিবেচনা করেই আমরা সে সময় হোটেলটিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডে বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে হোটেলটির ফ্লোর স্পেস, জমি এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি জামানত রাখা হয়। বন্ডটির কুপন রেট নির্ধারণ করা হয় ১০ শতাংশ হারে। এর মানে বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে মূল অংকের সঙ্গে ১০ শতাংশ হারে সুদ পাবে আইসিবি। বন্ডটির ২০ শতাংশ শেয়ারে রূপান্তর করার সুযোগও রাখা হয় চুক্তিতে। অবশ্য এটি নির্ভর করবে আইসিবির ইচ্ছার ওপর। তারা চাইলে শেয়ারে রূপান্তর করা হবে আর না চাইলে রূপান্তরের সুযোগ নেই। রূপান্তরের ক্ষেত্রে প্রতি শেয়ারের দর নির্ধারিত হবে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের শেয়ারের বাজারমূল্য এবং অভিহিত মূল্যের গড়ের ভিত্তিতে। বন্ডটির মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে ইস্যুর পর থেকে আট বছর। এর মধ্যে মরাটরিয়াম পিরিয়ড দুই বছর। অর্থাৎ এ সময় শুধু সুদ ছাড়া আর কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি ছয় মাসে ৫৪ কোটি টাকা করে মোট ১২টি কিস্তিতে বন্ডের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। সে হিসাবে প্রতি বছর সুদসহ ১০৮ কোটি টাকা কিস্তি পরিশোধ করার কথা রয়েল টিউলিপের।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে কেবল এক বছরে ৫০ কোটি টাকার ওপর ব্যবসা করতে পেরেছে হোটেল রয়েল টিউলিপ। এ পরিমাণ ব্যবসা দিয়ে প্রতি বছর আইসিবির বন্ডের ১০৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা সত্যিই দুরূহ তাদের পক্ষে। তার ওপর নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে গত বছরের মার্চ থেকে দেশের পর্যটন খাতের ব্যবসায় ধস নেমেছে। এটি রয়েল টিউলিপের আয়েও প্রভাব ফেলেছে। গত বছরের ৩০ এপ্রিল বন্ডের প্রথম কিস্তির ৫৪ কোটি টাকা পরিশোধের সময়সীমা নির্ধারিত থাকলেও তা পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। এরপর দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ দেয়ার কথা ছিল গত বছরের ৩১ অক্টোবর। এ কিস্তির অর্থও পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তী কিস্তির সময় নির্ধারিত রয়েছে আগামী ৩০ এপ্রিল।
সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা দুই দফা কিস্তির অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে আইসিবির কর্মকর্তাদের কপালে। এর মধ্যেই তারা অর্থ আদায়ে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। অর্থ আদায়ে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে বন্ডটির ট্রাস্টি গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সকেও। যদিও ট্রাস্টির পক্ষ থেকে সাড়া পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানটি। অন্যদিকে সুদ ছাড়াই বন্ডের অর্থ পরিশোধের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়েছে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আইসিবিকে চিঠি পাঠিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, কভিড–১৯–এর কারণে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে দুই কিস্তির অর্থ বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে তারা ৫ কোটি টাকা দিয়েছে। সুদ মওকুফ করে শুধু ৩২৫ কোটি টাকা পরিশোধের সুযোগ দেয়া যায় কি না, এজন্য সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। আমাদের পর্ষদ সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। পাশাপাশি কিস্তির অর্থ পরিশোধের জন্য বন্ডটির ট্রাস্টি গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সকে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে কিন্তু তারা কোনো জবাব দেয়নি।
সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের বন্ডের ট্রাস্টি গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারজানা চৌধুরীর কাছে আইসিবির চিঠির জবাব না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এটি ঠিক নয়। এ ধরনের কিছু ঘটেনি। মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় তিনি এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত জানাবেন বলে জানান। যদিও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি আর যোগাযোগ করেননি।
২০১৭ সালে আইসিবির কাছ থেকে বন্ডের মাধ্যমে অর্থ নেয়ার দুই বছর পর ২০১৯ সালে পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে ১৫ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। উত্তোলিত অর্থ ১৫৭টি রুমের ইন্টেরিয়র, ফিনিশিং, ফার্নিচার ও ফিক্সচার, জমি অধিগ্রহণ ও আইপিও প্রক্রিয়ার ব্যয় নির্বাহে ব্যবহার করা হয়। কোম্পানিটির আইপিও প্রসপেক্টাস অনুসারে ২০১৫–১৬ হিসাব বছরে ৭ কোটি ৪৬ লাখ, ২০১৬–১৭ হিসাব বছরে ৩৩ কোটি ১৬ লাখ এবং ২০১৭–১৮ হিসাব বছরে ৪৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যবসা করেছে। আর গত দুই বছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৮–১৯ হিসাব বছরে ৫১ কোটি ২৮ লাখ এবং ২০১৯–২০ হিসাব বছরে ৪৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যবসা হয়েছে।
কোম্পানিটির আইপিও প্রসপেক্টাসে আইসিবির বন্ডের অর্থ পরিশোধের বিষয়টিকে কোম্পানির জন্য অন্যতম একটি আর্থিক ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১০৮ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। যদি এ সময় কোম্পানি তার পরিচালনা কার্যক্রম থেকে পর্যাপ্ত নগদ প্রবাহ নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে এটি কোম্পানির ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যবসায়িক ঝুঁকি তৈরি করবে। আর হয়েছেও তা–ই।
বন্ডের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার কোম্পানি সচিব আজহারুল মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা বন্ডের পুরো অর্থই পরিশোধ করে দেব। এজন্য আইসিবির কাছে আর্লি সেটেলমেন্টের জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত আইসিবি থেকে কিছু জবাব আসেনি।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেডের বন্ড অনুমোদন করে। কমিশনের মতে, কোনো কারণে বন্ডে অর্থ পরিশোধে ইস্যুয়ার ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রে অর্থ আদায়ের জন্য ট্রাস্টিকে মূল ভূমিকা রাখতে হবে।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, বন্ডের ইস্যুয়ার যদি অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয় তাহলে সেক্ষেত্রে এর ট্রাস্টিকে দায়িত্ব নিতে হবে। প্রয়োজনবোধে জামানত রাখা সম্পদ বিক্রি করে হলেও বিনিয়োগকারীকে বন্ডের অর্থ পরিশোধের উদ্যোগ নিতে হবে ট্রাস্টিকে।