ফোটোনিক্স : কম্পিউটারের অনিবার্য বিপ্লব

TechtunesBd

‘কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি’র সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুরো দুনিয়া। এখন প্রশ্ন কেবল একটাই — তাহলে কি আজকের যুগের সাধারণ ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের বদলে খুব শিগগিরই বাজারে আসতে চলেছে ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটার’? গুগল দাবি করেছে তারা এটা আবিষ্কার করে ফেলেছে। কিন্তু অনেকেই মনে করছে, সম্ভব নয়। কেন?

প্রথমত, এই কোয়ান্টাম প্রযুক্তি এখনো একদমই সূচনা-পর্বে। সুপার কন্ডাক্টিং পদার্থ দিয়ে তৈরি এই কম্পিউটার শুধুমাত্র অতিশীতল (প্রায় শূন্য কেলভিন) উষ্ণতায় সঠিকভাবে কাজ করবে, যা আপনার আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শুধুমাত্র ল্যাবরেটরিতেই সম্ভব। দ্বিতীয়ত, মজার ব্যাপার হল কোয়ান্টাম কম্পিউটারের অলৌকিক দক্ষতার পরিসর সীমিত। ব্যাংকিং, ই-কমার্স বা কিছু বিশেষ গবেষণায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার দক্ষ হলেও দৈনন্দিন অতিসাধারণ সব কাজ, যা বাড়ির ডেস্কটপ বা ‘পিসি’ দিয়ে করা যায়, সেই কাজে এই কম্পিউটার আজকের ইলেকট্রিক কম্পিউটারগুলোর থেকে আদৌ পারদর্শী হবে কি না তর্কসাপেক্ষ। বরং ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের বদলে শিগগিরই যা বাজারে আসতে চলেছে তা হলো ‘ফোটনিক কম্পিউটার’। আনতে চলেছে ইনটেল, আইবিএম অ্যাপলের মতো বড় বড় সংস্থা। ইলেকট্রনিক্সের সঙ্গে এর তফাতটা কোথায়?

ভেবে দেখুন, আমাদের হাতের মুঠোয় বন্দি ছোট্ট স্মার্ট ফোন, ডেস্কের উপর রাখা ছিমছিমে টেলিভিশন কিংবা ল্যাপটপ, এই ইলেকট্রনিক যন্ত্রগুলো সবই চলে তড়িৎ শক্তিতে। সে বোঝে শুধু ভোল্টেজের ওঠানামা। যদি ভোল্টেজ কম দেয়া হয় তবে বোঝে ‘০’ আর বেশি দিলে (সাধারণত ৫ ভোল্ট) ‘১’। যা কিছু কাজ, জটিল গাণিতিক হিসেব-নিকেশ, রকেট উৎক্ষেপণ থেকে গেম খেলা, চ্যাট বা সিনেমা দেখা, সবই হয় এই ‘০’ ও ‘১’-এর কম্বিনেশনে। শুধুমাত্র দুটি ‘বিট’ ০ ও ১ এর সমন্বয়ে তৈরি এহেন গাণিতিক শাখাকে বলে ‘বাইনারি সিস্টেম’, যা ডিজিটাল ইলেকট্রনিক্সে ব্যবহার হয়।

ইলেকট্রনিক যন্ত্রে উপযুক্ত সেমিকন্ডাক্টিং মাধ্যম যেমন সিলিকন-এ তড়িৎ বা ইলেকট্রনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তাকে নিজের সুবিধা মতো কাজে লাগানো হয়। যন্ত্রগুলোর মধ্যে থাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ‘স্যুইচ’ বা ট্রানজিস্টার। যা ভিতরের সার্কিটের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ ও অভিমুখকে আমাদের প্রয়োজন অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করে। বাইরে থেকে কি-প্যাডের মাধ্যমে আমরা আসলে এই স্যুইচগুলোই অন বা অফ করে সার্কিটের ভোল্টেজে নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। আজকের উন্নত কম্পিউটারে এরকম কয়েক কোটি স্যুইচ বা ট্রানজিস্টার থাকে। যেগুলোকে আমরা বাইরে থেকে নিমেষের মধ্যে অন বা অফ করতে পারি।

কম্পিউটারের স্পিড কত বেশি হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে কত দ্রুত এই স্যুইচগুলো অফ বা অন করা যায়। এককথায় কম্পিউটারের ক্লক-স্পিড-এর উপর। যেমন, আমাদের কম্পিউটারের এই ক্লকগুলোর স্পিড সাধারণত গিগা (১০৯) হার্ৎজ হয়। যার অর্থ হলো, এই কম্পিউটারের কন্ট্রোলিং স্যুইচগুলো সেকেন্ডে প্রায় ১০৯ (এক শ’ কোটি) বারের বেশি অন-অফ করা যায়। ‘Windows’-এর ‘run’-এ গিয়ে ‘dxdiag’ টাইপ করলেই প্রসেসর স্পিড কত তা দেখা যায়। বুঝতেই পারছেন, সেকেন্ডে কয়েক শ’ কোটি সংখ্যাটা নেহাতই ছোট নয়। কিন্তু, সাত শ’ কোটি মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা এতেও মেটে না।

কী করে এই কম্পিউটারগুলোকে আরো ছোট, গতিশীল ও সুদক্ষ করে তোলা যায়, তার জন্য নিরন্তর গবেষণা চলছে। সমস্যা এখানেই। ইলেকট্রন ধাতব তারের মধ্যে দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গতিতে চলাচল করে। এই গতি আলোর বেগের কয়েক শ’ ভাগের এক ভাগ। আবার ইলেকট্রনিক সার্কিট ইচ্ছেমতো ছোট করা সম্ভব না। কারণ, যখনই দু’টি ইলেট্রনিক সার্কিট কাছাকাছি আসে, তখন তাদের মধ্যে তড়িৎ-কণা বা চার্জ জমিয়ে রাখার ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়। এই ঘটনাকে বলে ধারকত্ব বা Capacitance. এরা তখন পাত্রের মতো ইলেকট্রনগুলিকে এদের মধ্যে বন্দি করে ফেলে। ফলে, আমরা যতই তাড়াতাড়ি বাইরে থেকে স্যুইচগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি না কেন, বন্দি ইলেকট্রনগুলো সহজে নড়াচড়া করতে পারে না। তাই কম্পিউটারের স্পিডও তার আকার যত ছোট হয়, তত কমতে শুরু করে। এই সমস্যার সমাধানেই আজ আমরা আলোকবিজ্ঞানের একটি শাখা ফোটোনিক্স বা আলোক-কণা বিজ্ঞানের শরণাপন্ন।

ইলেকট্রনিক্সের মতোই আলোকবিজ্ঞানের ব্যবহার সর্বত্র। হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরে দুই দানবিক যমজ কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষে তৈরি অতি দুর্বল মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পরিমাপ থেকে অতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণুর কম্পনের মাধ্যমে এক সেকেন্ডের এক কোটি ভাগের এক ভাগ সময় মাপার নিখুঁত ঘড়ি তৈরি পর্যন্ত বিস্তার আলোকবিজ্ঞানের। আবার সমুদ্রের নিচে পাতা মাইলের পর মাইল দীর্ঘ অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের সৌজন্যে আজ আমাদের বাড়িতে দ্রুত-গতি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট যা আমার আপনার নিত্যসঙ্গী। আলোক ঝলমল পুজো প্যান্ডেলের LED লাইট, ছানি অপারেশনে ব্যবহৃত লেসার রশ্মি বা আপনার টেবিলে অযত্নে লালিত ধুলোমাখা সিডি, সবই আলোকবিজ্ঞানের দান।

খামখেয়ালি আলোর দ্বৈতসত্তাও রয়েছে। সে কখনো তরঙ্গধর্মী, আবার কখনো কণাধর্মী। যেকোনো বস্তু থেকে যখন আলো তরঙ্গের মতো প্রতিফলিত হয় তখন আমরা বস্তুটিকে দেখতে পাই। আবার আলোককে ছোট ছোট একগুচ্ছ কণা বা ফোটনের সমন্বয় হিসেবে না ভাবলে আলোক-তড়িৎক্রিয়ার ব্যাখ্যা করা সহজসাধ্য হয় না। আইনস্টাইন এই আলোক-তড়িৎক্রিয়া আবিষ্কারের মাধ্যমে আলোক কণাধর্ম প্রমাণ করেই ১৯২১ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। এই আলোক-কণা বা ফোটন ভরহীন, চার্জবিহীন এক ধরনের বোসন কণা যা আলোর বেগে ছুটে চলে।

ফোটোনিক কম্পিউটারগুলিতে থাকে ছোট ছোট লেজার। লেজার অন থাকলে ১, আর বন্ধ থাকলে ০ বোঝায়। নিরলস গবেষণায় আবিষ্কৃত হয়েছে অপিটক্যাল ট্রানজিস্টার বা স্যুইচ। যা আলোর গতিবিধি ও লেজারগুলোর অন-অফ নিয়ন্ত্রণ করে। শুরুতে তামার তারের বিকল্প হিসেবে আসে, অতিসূক্ষ্ম কাচের তার। যাদের বলে অপটিক্যাল ওয়েভ গাইড। এরা মানুষের চুলের প্রায় ১০০ ভাগের এক ভাগ হলেও বিনাবাধায় আলোকে সার্কিটের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিমেষে পৌঁছে দেয়। দেখা যায়, ফোটনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে আরো ছোট আকারের কম্পিউটার তৈরি করা যায়, যার ক্লক-স্পিড কমপক্ষে কয়েক হাজারগুণ বেশি (১০১২ বা টেরা-হার্ৎজ)। এছাড়াও ফোটন ভর ও চার্জহীন হওয়ায়, ফোটোনিক্স সার্কিটে খুব কম তাপ উৎপন্ন হয়। ফলে শক্তির অপচয় কমে।

নতুন যুগের কম্পিউটারে ইলেকট্রনিক্সের বদলে যে ফোটোনিক্স আসতে চলেছে, তা বুঝতে পেরেছে আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, জামার্নি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, চীন, জাপান, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলো। অর্থাৎ, কয়েক ধাপ এগিয়ে এই ফোটোনিক্সই আমাদের উন্নততর ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটার’ তৈরির লক্ষ্যে বিপ্লব আনতে চলেছে। এককথায় ইলেকট্রনিক যুগের অবসান অবশ্যম্ভাবী। নতুন যুগের সূচনা হবে আলোকবিজ্ঞানের হাতেই।

সূত্র : onnoekdiganta