পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঘোড়ার গাড়িতে করে ছুটে চলছেন মাঝ বয়সী এক নারী, সেটা আবার ইউরোপের কোনও দেশে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে আজকের দিনে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গরু কিংবা ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন তেমন একটা দেখা যায় না।
কিন্তু ইউরোপের কোনও দেশে হঠাৎ করে যদি এমন কিছু দৃশ্যের কথা শোনেন তাহলে রীতিমতো চোখ কপালে উঠাটা অস্বাভাবিক কিছুই না। তবে এখানে ঘটনাটি একেবারে অন্যরকম। সেকেন্ড ওয়েভে করোনা সংক্রমণের ক্রমাগত ঊর্দ্ধগতির কারণে রীতিমতো বিধস্ত পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ১১ লাখের বেশি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণঘাতী ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে দেশটিতে ১৯,০০০ এরও বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে করোনা সংক্রমণ রোধ করতে ইউক্রেনের সরকার ইতোমধ্যে দেশটির বিভিন্ন অংশে লকডাউন রয়েছে।
ঠিক এ রকম একটি সন্ধিকালীন মুহূর্তে আচমকা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝ বয়সী এক ভদ্রমহিলার ছবি ভাইরাল হয়। যেখানে তাকে কার্পেথিয়ান পর্বতমালা সংলগ্ন কোনও একটি গ্রামের কাঁচা রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ছুটতে দেখা যায়। পরবর্তীতে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।
ওই মহিলার নাম ভিক্টোরিয়া মাহনিচ। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, মূলত কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে তার এ প্রয়াস।
ভিক্টোরিয়া বলেন, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে আমরা পৃথক রাষ্ট্র গঠন করি। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী তিন দশকেও আমাদের অবকাঠামো কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থায় খুব একটা উন্নতি আসেনি এবং কোনও সরকারই আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি। এ কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর মানুষের মাঝে চিকিৎসা সেবা পৌঁছানো সত্যি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়।
বর্তমানে ভিক্টোরিয়ার অধীনে প্রায় ২,০৩০ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। যদিও তাদের মাঝে কতজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছুই জানা যায়নি।
তিনি আরও জানান, কার্পেথিয়ান গ্রাম সংলগ্ন এ গ্রামগুলোতে সেভাবে যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এমনকি চিকিৎসার জন্য কাছাকাছি কোথাও সে অর্থে বড় কোনও হাসপাতাল তৈরি হয়নি। তাই এখানকার মানুষের মাঝে জরুরি চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে আমি একা দিনরাত অঘোষিত ওয়ান ম্যান আর্মির দায়িত্ব পালন করছি।
এ বিষয়ে আমি আমার স্বামীর কাছ থেকে যথাসম্ভব সমর্থন পেয়েছি এবং তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে আমার কাজে সহায়তা করেন। তিনি প্রায়ই তার গাড়িতে করে আশপাশের গ্রামগুলোতে আমাকে লিফট দেন তবে বর্তমানে তার একমাত্র গাড়িটি অনেকটা পুরাতন ও অকেজো হয়ে পড়েছে।
তাই যাতায়াতের জন্য আমি কয়েক মাস পূর্বে একটা মোটরসাইকেল কিনেছি। তবে প্রতিকূল আবহাওয়ায় এ রকম জায়গায় মোটরসাইকেল চালানো অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এর আগে এখানকার রাস্তা সংস্কারের পাশাপাশি গ্রামবাসীর চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম কিন্তু এখনও তাদের পক্ষ থেকে উত্তর দেওয়া হয়নি।
ভিক্টোরিয়া বলেন, আমার স্বামী আমাকে ইতোমধ্যে কয়েকবার আশপাশের কোনও শহরে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। তবে আমি যদি এখন থেকে চলে যাই তাহলে এখানকার মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার কেউ থাকবে না। এছাড়াও গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকেও আমি ভালোবেসে ফেলেছি।
তাই তাদের ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা এ মুহূর্তে ভাবতে পারছি না। এখন আমাকে দেখলে তারা নিজের থেকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে গ্রামগুলোকে দেখতে বেশ ভালো লাগে। তবে একটা সমস্যা হচ্ছে, এখনো এখানকার মানুষেরা স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন নয়।
প্রথম যখন পিপিই পরিধান করে একজন রোগীর কোভিড টেস্ট করতে যাই তখন আশপাশের মানুষজন এটিকে ভালোভাবে নেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে এখন পিপিই ছাড়াই সবাইকে চিকিৎসাসেবা দিতে হয় যা সত্যি চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়।
এছাড়াও নববর্ষ উদযাপন কিংবা অর্থোডক্স খ্রিস্টমাস উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের সমাগম হয়েছে, ফলে সামনের দিনগুলোতে আক্ষরিক অর্থে আবারও করোনা সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। জানি না এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমি কতটুকু দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারব?
করোনা প্রতিরোধে ইতোমধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ টিকা কার্যক্রম শুরু করেছে তবে এখনও ইউক্রেন অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যে রয়েছে। আর্থিক অস্বচ্ছলতা এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এ মুহূর্তে দেশটির সরকারও ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির বিষয়ে কার্যকরি সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না তবে প্রেসিডেন্ট ভ্লোদিমির জেলেস্কি আগামী মার্চ কিংবা এপ্রিলের মধ্যে ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
এমআরএম/এমএস